শুক্রবার,১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


ক্রাইস্টচার্চে আজান আর নীরবতায় ঐক্যের জয়গান


পূর্বাশা বিডি ২৪.কম :
২৩.০৩.২০১৯

ডেস্ক রিপোর্ট :
জুমার নামাজের আগে ইমাম জামাল ফাউদা দেখলেন, বুলেট জর্জরিত আল নূর মসজিদের বাইরে হ্যাগলি পার্কে জড়ো হয়েছেন হাজারো মানুষ
শুক্রবার আল নূর মসজিদের বাইরে হ্যাগলি পার্কে জড়ো হন হাজারো মানুষ। অন্য ধর্মের নারীরাও মাথায় হিজাব পরে সেখানে উপস্থিত ছিলেন -ইন্টারনেট

এক সপ্তাহ আগে ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদের ইমাম জামাল ফাউদা বর্ণবাদী এক খুনির চোখে দেখেছেন জিঘাংসা, দেখেছেন প্রার্থনারত মানুষের রক্ত, দেখেছেন বন্ধু-স্বজনের অসহায় মৃত্যু।

ঠিক সাত দিন পর এল আরেক শুক্রবার। জুমার নামাজের আগে ফাউদা দেখলেন, বুলেট জর্জরিত আল নূর মসজিদের বাইরে হ্যাগলি পার্কে জড়ো হয়েছে হাজারো মানুষ, তাদের মধ্যে আছেন স্বয়ং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। দেখলেন, সবার বিষাদভরা চোখে ভালোবাসা, সহমর্মিতা।

ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে উগ্র ডানপন্থি এক সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত অর্ধশত মানুষের স্মরণে শুক্রবার দুপুরে দুই মিনিটের জন্য নীরব থাকে পুরো নিউজিল্যান্ড। ঠিক তার আগে নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমানদের প্রতি সংহতি জানাতে সকল প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হলো জোহরের আজান।

গত ১৫ মার্চ ওই হামলার ঘটনার পর থেকে প্রতিদিনই সব ধর্মের নানা বয়সী মানুষ ফুল হাতে ওই মসজিদের বাইরে আসেন সংহতি জানাতে। মাওরি আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী রণনৃত্য হাকা পরিবেশন করে শ্রদ্ধা আর সংহতি জানাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা।

আল নূর মসজিদে হাজার হাজার মানুষের সামনে ইমাম জামাল ফাওদা যে বক্তৃতা দেন, সেটি আলোড়িত করে সব মানুষকে।

তিনি বলেন, গত শুক্রবার আমি এ মসজিদটিতে দাঁড়িয়েছিলাম এবং সন্ত্রাসীর চোখেমুখে ঘৃণা ও ক্ষোভ দেখেছি। এতে ৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪২ জন আর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের মন ভেঙে গেছে। আজ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন চারপাশে তাকিয়েছি, তখন নিউজিল্যান্ড ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের চোখে ভালোবাসা ও সহানুভূতি দেখেছি। এতে আরও লাখ লাখ মানুষের হৃদয় ভরে গেছে, যারা আমাদের সঙ্গে এখানে শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তাদের আত্মা আমাদের সঙ্গেই আছে।

০ সন্ত্রাসী আমাদের দেশকে তার অশুভ মতাদর্শ দিয়ে বিভক্ত করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বদলে আমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পেরেছি যে নিউজিল্যান্ড ভেঙে টুকরো হয়ে যায়নি। বরং বিশ্ব আমাদের ভালোবাসা আর ঐক্যের উদাহরণ হিসেবে দেখছে। আমাদের মন ভেঙে গেছে, কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি। আমরা বেঁচে আছি। আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে কেউ আমাদের বিভক্ত করতে পারবে না।

০ শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের অশুভ এই মতাদর্শের প্রথম শিকার আমরা হইনি, কিন্তু তবু তা আমাদের ভীষণভাবে আঘাত করেছে। নিহত মানুষের সংখ্যা হয়ত অসাধারণ নয়, বরং নিউজিল্যান্ডের মানুষের যে সংহতি আমাদের সঙ্গে তা অসাধারণ।

০ এই হামলায় যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে বলছি আপনাদের স্বজনের মৃত্যু বৃথা যায়নি। আশার বীজে জল সঞ্চার করেছে তাদের রক্ত। তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী ইসলাম এবং আমাদের ঐক্যের সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। আল্লাহর রাস্তায় গিয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে, দয়া করে বলবেন না তারা মৃত, তারা বেঁচে আছে, তাদের প্রভুর কাছে আনন্দে আছে।

০ আপনাদের হারিয়ে নিউজিল্যান্ডের ঐক্য ও শক্তি জোরদার হয়েছে। কিন্তু আপনাদের চলে যাওয়াটা যেন নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্ব মানবতার জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল।

০ ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ হন্তারক। মুসলমানেরা আগেও এর শিকার হয়েছে। কানাডা, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ইসলাম বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন অনেক মানুষ।

০ কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষ খুবই বাস্তব। এ মতাদর্শ মানুষের মানবতা ভুলে অযৌক্তিকভাবে মুসলমানদের সম্পর্কে ভীতি ছড়ায়। আমরা কী কাপড় পরি, কোন ধরনের খাবার খাই, যেভাবে আমরা নামাজ পড়ি আর যেভাবে নিজেদের বিশ্বাস আমরা লালন করি, তা সম্পর্কে ভীতি ছড়ায়। আমরা নিউজিল্যান্ডের সরকার এবং আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে আহ্বান জানাই হেটস্পিচ বা হিংসাত্মক বক্তৃতা ও ভয়ের রাজনীতির ইতি টানার জন্য যেন উদ্যোগ নেয়া হয়।

০ শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের উত্থান এবং ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলতা বিশ্ব মানবতার জন্য বিরাট এক হুমকি এবং এর অবসান এক্ষুনি হতে হবে।

ইমাম তার বক্তব্যে গত শুক্রবারের ঘটনায় হতাহতদের প্রতি নিউজিল্যান্ডের মুসলমান ও অমুসলমানদের ভালোবাসা এবং চোখের জলের জন্য ধন্যবাদ জানান। নিউজিল্যান্ডের মানুষ মুসলমানদের সাথে সংহতি জানিয়ে যে ঐতিহ্যবাহী হাকা নৃত্যের আয়োজন করেছে সে জন্য ধন্যবাদ জানান।

আর নামাজে আসা মুসলমানদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে আজ পুরো নিউজিল্যান্ড কাঁদছে। আমরা সবাই আজ এক।’

নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের খবরে বলা হয়, জুমার নামাজের সময় হ্যাগলি পার্কের এই সমাবেশে জড়ো হয়েছিল প্রায় দশ হাজার মানুষ। মুসলমান রীতিতে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় আধা ঘণ্টা। বেল সিবলি নামে ক্রাইস্টচার্চের এক নারী তার হিজাব পরার কারণ তুলে ধরে বলেন, কেউ একজন বন্দুক তুলে ধরলে তিনি বন্দুকধারী ও নিশানায় থাকা ব্যক্তির মাঝখানে দাঁড়াবেন। যাতে বন্দুকধারী দুজনের মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে না পায়।

একজন নারী পুলিশকে ক্রাইস্টচার্চ সমাধিতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে মাথায় স্কার্ফ পরে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।

এছাড়া মুসলমানদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে নিউজিল্যান্ডের অন্য ধর্মের নারীরাও মাথায় হিজাব পরে সেখানে হাজির হয়।

শ্রদ্ধা জানানোর এই আনুষ্ঠানিকতায় অকল্যান্ডের চারটি মসজিদ শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সব ধর্মের মানুষের জন্য খোলা থাকে। সন্ধ্যায় অকল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো পার্ক অকল্যান্ড ডোমেইনে হয় প্রদীপ প্রজ্বলন।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী সে দেশের মানুষকে নীরবতা পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন, অনেক নিউজিল্যান্ডবাসী হামলার পর থেকে দিনটিকে স্মরণ করতে চেয়েছেন এবং মসজিদে ফিরে আসা মুসলিমদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে চেয়েছেন। নীরবতা পালনের ভাষা একেকজনের একেক রকম হতে পারে। যে যেভাবে ঠিক মনে করবেন সেভাবে পালন করবেন। বাড়ি, কর্মস্থল, স্কুলে যে যেভাবে পারবেন।



এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি