সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আল্লাহ তায়ালা কাবাকে তাঁর মনোনীত বান্দাদের মিলনক্ষেত্র হিসেবে কবুল করেছেন। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান, যা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত। কাবা শরিফ জমিনের ওপর আল্লাহ পাকের ইবাদত করার জন্য নির্মিত প্রথম ঘর। সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই গোটা মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘরটি (কাবাঘর) তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল বাক্কায় (অর্থাৎ মক্কায়) এ ঘরকে কল্যাণ ও মঙ্গলময় এবং মানব জাতির হেদায়েত লাভের কেন্দ্রবিন্দু বানানো হয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান-৯৬)। কাবা শরিফ সারা বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ। বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ও বাইতুল্লাহর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা মায়েদা : ৯৭)।
এ কারণে কাবাঘর মুসলমানদের কেবলা। আমরা প্রতিনিয়ত নামাজে কাবাঘরের দিকে মুখ করে বা কাবাকে কেবলা বানিয়ে নামাজ পড়ি।
প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমান কাবাঘর তাওয়াফ করতে মক্কা গমন করেন। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা কাবাঘর নির্মাণ করেন। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, চতুর্থ আকাশে বা দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে সুন্দর পাথর দ্বারা নির্মিত একটি মসজিদ রয়েছে, যার নাম বাইতুল ইজ্জত, যাকে বাইতুল মামুরও বলা হয়। এটি কাবা শরিফের বরাবর দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে ফেরেশতাদের ইবাদতগাহ। ফেরেশতারা এখানে আল্লাহ পাকের ইবাদতে মগ্ন থাকেন। মুসলিম জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। তখন আল্লাহ্ পাকের হুকুমে ফেরেশতারা বাইতুল মামুরের নকশা পৃথিবীর মধ্যস্থলে ফেলে দেন। হজরত আদম (আ.) ওই নকশার ওপর ভিত্তি করে ওই স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদই আমাদের বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর।
পরবর্তীতে হজরত ইবরাহিম (আ.) পবিত্র কাবা শরিফ ফের নির্মাণ করার পর মহান আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দেন, ‘বিশ্ববাসীকে এ ঘর তওয়াফ করার আহ্বান জানাও।’ তিনি আরজ করেন, ‘হে রব! এখানে তো জনমানবহীন প্রান্তর। আমার আহ্বান জগদ্বাসী কীভাবে শুনবে?’ মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমার দায়িত্ব কেবল ঘোষণা দেওয়া। পৌঁছানো আমার কাজ।’ তারপর তিনি মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘ওহে লোকসকল, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করে তার জিয়ারত তোমাদের ওপর ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা এ ঘর প্রদক্ষিণ করতে এসো।’ তাঁর এ আওয়াজ মহান আল্লাহ পাক বিশ্বের আনাচে-কানাচে পৌঁছে দেন। কিয়ামত অবধি যত মানুষের আগমন ঘটবে এ ধরণিতে, সবার কানে এ আওয়াজ পৌঁছেছিল রুহের জগতে। তখন যারা ‘লাব্বাইকা’ বলেছেন, তাঁরা এ ঘরের জিয়ারত করে ধন্য হবেন।
হজরত ইবনে আব্বাস রদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, পবিত্র হজে ‘লাব্বাইকা’ বলে যে তালবিয়া পাঠ করা হয়, তা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সে আহ্বানেরই জবাব। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে পবিত্র হজের ঘোষণা প্রচার করো। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে।’ (সূরা হজ : ২৭)। কাবার ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে শিরকমুক্ত নির্ভেজাল একত্ববাদের ওপর। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করুন সে সময়কে, যখন আমি ইবরাহিমকে বাইতুল্লাহর স্থান নির্ধারণ করে বলেছিলাম যে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।’ (সূরা হজ : ২৬)। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিল : হে আমাদের রব! (এ কাজ) আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন।’ (সূরা বাকারা : ১২৭)।
ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে কাবাকে কেন্দ্র করেই। নামাজ, হজ, কোরবানি, পশু জবাই ও মৃতের দাফনÑ সবকিছু আদায় করতে হয় কাবার দিকে ফিরেই। হাদিসের ভাষ্য মতে, কাবাগৃহে এক রাকাত নামাজ আদায় করলে এক লাখ রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়। কাবা শরিফের এ বিশেষ মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কথা বিবেচনা করে ইসলাম কাবার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বসবে, সে যেন কেবলাকে সামনে বা পেছনে না রাখে।’ (মুসলিম)। কাবাঘরের চারদিকে বেষ্টনীর চত্বর মসজিদে হারাম। এখানে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অকল্পনীয় নেকি লাভ করা যায়, যা অন্য কোথাও হাসিল করা যায় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার মসজিদে একবার সালাত আদায় মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে হাজারবার সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি উত্তম। তবে মসজিদুল হারামে একবার সালাত আদায় অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক লাখ গুণ বেশি।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
কাবা শরিফকে গিলাফে আবৃত করার প্রচলন শুরু হয় প্রাচীন জুরহুম গোত্রের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে এ ধারা চলমান থাকে। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কাবা ঘরকে একটি সাদা ইয়েমেনি চাদরে আবৃত করেন। পরবর্তী খলিফারা কাবাঘরের গিলাফের ক্ষেত্রে সাদা, লাল এবং সবুজ রঙ ব্যবহার করেছেন। আব্বাসি খলিফারা কালো গিলাফের প্রচলন করেন।
এখনো সেই কালো রঙেই বহাল আছে।
জুলাই ২০১৭/রুমকী