পূর্বাশা ডেস্ক:
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে চতুর্থ তলায় উঠতেই মেঝেতে দেখা গেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক রোগী শুয়ে আছে। গরমে রোগীদের পাশাপাশি হাঁসফাঁস করছে তাদের স্বজনরাও। অথচ বাঁ পাশের ২৪ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডটি খালি।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মেঝের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদককে সার্জারি বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘দেখছেন কী, এগুলো সব ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের রোগী। ওয়ার্ড তো পঞ্চম তলায়। ’
তাহলে চতুর্থ তলায় কেন—এমন প্রশ্নে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘এক ফ্লোর ওপরে গিয়ে (৫ম) দেখেন, সেখানেও অনেক রোগী। ’ তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে দেখেছেন রোগীর হালচিত্র। একটু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখেন রমজান মাসেও বিভিন্ন ওয়ার্ডে কী পরিমাণ রোগী রয়েছে। ’
এদিকে পঞ্চম তলার ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক ওয়ার্ডেও অনেক রোগী। ওয়ার্ডে ঢুকতেই বাঁ পাশে মিনি অপারেশন থিয়েটার (ওটি)। ওটির দরজা খুলতেই দেখা যায় দুটি টেবিলে রোগী। একটিতে এক রোগী অপেক্ষা করছে; অন্যটিতে চিকিৎসকের কাজ করছেন এক সুইপার, দুজন চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ছাত্রী এবং একজন শিক্ষানবিশ নার্স। তাঁরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক রোগীর (যুবক) ভাঙা ডান হাতে কাস্ট (প্লাস্টার ব্যান্ডেজ) দেওয়ার ওই দৃশ্য ধারণ করা হয়। এর আগে ওই যুবকের বাঁ পায়ে লং কাস্ট দেন তাঁরা। আহত যুবকের নাম মো. বখতেয়ার (১৮)।
দেখা গেছে, সুইপার তপন দাশ তাঁকে ডান হাতে কাস্ট দিচ্ছেন। এ সময় তাঁকে ওটিতে সহযোগিতা করছেন চমেক নার্সিং কলেজে অধ্যয়নরত দুই ছাত্রী এবং এক ইন্টার্ন নার্স (ছাত্রী)। এই ওটির সামনে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ইকবাল হোসেনের কক্ষ। সেখানে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখা যায় কেউ নেই। কক্ষের সামনে দাঁড়ানো কর্মচারী পরিচয় দেওয়া এক কর্মচারী বলেন, ‘স্যারকে আজ (বৃহস্পতিবার) পাবেন না, শনিবার পাবেন। উনি অপারেশন থিয়েটারে (রুটিন) আছেন। ’
এদিকে প্রতিবেদককে দেখে মিনি ওটিতে থাকা সুইপার ও নার্সরা হতভম্ব হয়ে যান। পাঁচ মিনিট পর সেখানে আরো দুই রোগী নিয়ে ঢোকেন ওয়ার্ডের সর্দার (চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী) রুহুল আমিন, কর্মচারী আবদুর রউফসহ আরো দু-তিনজন। তাঁরা প্রতিবেদককে দেখার পর কিছুক্ষণ কাজ বন্ধ রাখেন। একে অন্যের মধ্যে চলে কানাঘুষা। বাইরে গিয়ে ওয়ার্ড থেকে দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে ঢেকে নিয়ে আসেন ওটিতে। তাঁরা এবার ওটিতে প্রবেশ করে সেখানে থাকা রোগীদের দেখা শুরু করেন।
আহত বখতেয়ারের মা বুলবুল আকতার ও চাচা ওসমান বলেন, ‘এখানে পদে পদে টাকা গুনতে হয়। ’ কোথায় কোথায় দিয়েছেন, জানতে চাইলে তাঁরা আরো বলেন, ‘হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে আনার জন্য কর্মচারীরা ২০০ টাকা নিয়েছে। এরপর টিকিট নিয়ে জরুরি বিভাগ থেকে হাসপাতালে এক্স-রে করানোর জন্য পাঠানো হয়। সেখানে এক্স-রের জন্য নিয়েছে ৬০০ টাকা। আর কর্মচারীরা নিয়েছে ৫০ টাকা। ট্রলি করে এ ওয়ার্ডে আনতে ১৩০ টাকা। চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনেছি ২০০০ টাকার। অপারেশন রুমে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের ২০০ টাকা দিয়েছি। জানি না আরো কত দিতে হবে?’
ওই ওয়ার্ডে ৮৫ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থেকে আসা দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র রমজান আলী (১১)। এই শিশুর বাঁ পা ভেঙে গেছে। তাকে ট্রাকশন দিয়ে টানা দেওয়া হয়েছে। সিট থেকে নিচে রশি দিয়ে ইট বাঁধা রয়েছে। সকাল ১১টা ৯ মিনিটে অসুস্থ রমজান আলীর মা জাহেদা বেগম বলেন, ‘২৮ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আমার ছেলে। বাড়িতে গাছ থেকে লিচু পাড়ার সময় পড়ে বাঁ পা ভেঙে গেছে। এখান থেকে তো প্যারাসিটামল ও দু-একটা কম দামি ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ পাচ্ছি না। গত ২৮ দিনে ২২-২৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। টানা দেওয়া ইট বাবদ ১০০ টাকা নিয়েছে একজন। ’
ওই ওয়ার্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নার্স জানান, অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ১১০টি শয্যা আছে। এখন (গতকাল সকাল ১১টা ২৫ মিনিট) রোগী আছে ২১০ জন। মাঝেমধ্যে ২৫০-এর বেশি রোগী থাকে। ’
ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে এক চিকিৎসক বলেন, ‘মিনি ওটির নিয়ন্ত্রক ওয়ার্ডের কর্মচারীরা। মাঝেমধ্যে চিকিৎসকরা যান। কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে তারা সবাই এক জোট হয়ে যায়। আমরা অসহায়। ’
এদিকে ওই ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, ৩১ জনের পায়ে ট্রাকশন (ইট) দিয়ে টানা রয়েছে। ইটের বিষয়টি জানতে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য বেরিয়ে আসে। সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করা কয়েক চিকিৎসক ও নার্স বলেন, অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ‘ইটের’ ব্যবসা জমজমাট। যখন এই ওয়ার্ডটি হয়েছিল তারও আগের (অন্য ওয়ার্ডে ছিল অর্থোপেডিক রোগী) অনেক ইট রয়েছে। রোগীর ওজন অনুসারে ইটের পরিমাণ নির্ভর করে। শিশুদের পায়ের একটি করে ইট দেখা গেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের একাধিক ইট টানা দেখা গেছে। ইট টানা দেওয়ার কাজটি করে কর্মচারী ও আয়ারা।
১১-বি শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে মিনি ওটিতে রোগী একজন। চিকিৎসক-কর্মচারী মিলিয়ে সেখানে ছয়-সাতজনকে দেখা গেছে। নগরের ‘প্রবর্তক’ সংঘ থেকে আসা এক শিক্ষিকা ওই ওটির বাইরে একজনকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘ওটিতে যারা আছে তারা কি ছোট চিকিৎসক, নাকি বড় চিকিৎসক?’ কেন জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, ‘বয়স কম দেখা যাচ্ছে। আর একজন ছাড়া অন্যদের কারো গায়ে তো অ্যাপ্রোন দেখা যাচ্ছে না। আমরা চিনব কিভাবে?’
একপর্যায়ে রুম থেকে অ্যাপ্রোন ছাড়া এক চিকিৎসক (পুরুষ) বের হয়ে আসছেন। এ সময় চিকিৎসককে ওই শিক্ষিকা বলেন, ‘আপনি ওষুধপত্র লিখে দিয়েছেন। আমি দোকানে গিয়ে দেখেছি এগুলোর দাম আসছে ৫০০ টাকা। আমার কাছে আছে ২০০ টাকা। আর ৩০০ টাকা কোথায় পাব? রোগী তো এতিম। প্রবর্তক সংঘে পড়ালেখা করে। ’
উত্তরে চিকিৎসক বলেন, ‘২০০ টাকা দিয়ে চিকিৎসা হবে নাকি?’
এদিকে গতকাল সকাল ১০টার দিকে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে এক চিকিৎসক বলেন, ‘আপনি হাসপাতালে আসছেন এ কথা শুনে মনে হয় আজ আমাদের ওটিতে চিকিৎসকরা সতর্ক হয়ে গেছেন। এখানে এক সিনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নন, এমন একজন (বহিরাগত) প্রায় সময় ওটিতে থাকেন। তিনি চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ’
পূর্বাশানিউজ/০২-জুন,২০১৭/ফারজানা